টাকার বিনিময়ে মাথা কেটে মিথ্যা গ্রিভিয়াস সার্টিফিকেট প্রদান! সিরাজগঞ্জে ডাক্তার ফয়সালের অপকর্মে ভুক্তভোগী সাধারণ মানুষ
- আপডেট সময় : ০৭:২৩:৫১ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৫ জুলাই ২০২৫ ৩৭৮ বার পড়া হয়েছে

ক্রাইম রিপোর্টারঃ
মানুষের জীবন বাঁচানো যেখানে একজন ডাক্তারের পবিত্র দায়িত্ব, সেখানে কিছু অসাধু চিকিৎসক টাকার লোভে আইনের অপব্যবহার করে মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলছে। এমনই এক ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটেছে সিরাজগঞ্জ জেলায়, যেখানে আলোচনায় উঠে এসেছে এক ‘অসৎ ও দুর্নীতিগ্রস্থ’ ডাক্তার ফয়সালের নাম।
ঘটনার শুরু
অনুসন্ধানে জানা যায়, তাড়াশ উপজেলার সাইফুল ইসলাম বাদী হয়ে ২৪ ফেব্রুয়ারি একটি মামলা দায়ের করেন, যা ২৬ ফেব্রুয়ারি তাড়াশ থানায় রেকর্ড হয়। এজাহারে বলা হয়—২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ তারিখে পরিকল্পিতভাবে হামলা চালিয়ে তার দুই ভাইকে লোহার রড দিয়ে নৃশংসভাবে পিটিয়ে একজনের দুই পা ভেঙে দেওয়া হয় এবং আরেকজনের মাথায় ধারালো ছোরা দিয়ে গুরুতর জখম করা হয়। এ মামলার আসামিরা ছিলেন মিঠু, মৃদুল, মঞ্জুরুল, মোয়াজ্জেমসহ আরও কয়েকজন।
তবে চিত্র পাল্টে যায় কয়েকদিন পর।
সাইফুল ইসলামের মামলা রেকর্ডের ৬ দিন পর, হামলার হুকুমদাতা হিসেবে অভিযুক্ত ও মামলার ৫ নং আসামি মোয়াজ্জেমের পিতা মজিবুর রহমান বাদী হয়ে ৩ মার্চ ২০২৫ তাড়াশ থানায় পাল্টা মামলা দায়ের করেন। যেখানে নিজামুদ্দিন ও সাইফুল ইসলামসহ ১৩ জনকে আসামি করা হয়।
তদন্তে ভয়ঙ্কর সত্য
পাল্টা মামলায় বলা হয়, আহতরা ২৩ ফেব্রুয়ারি থেকে ২৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সিরাজগঞ্জ কমিউনিটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন এবং ২৬ ফেব্রুয়ারি রাত ১১টার দিকে সদর হাসপাতালে ভর্তি হন। এরপর ২৭ ফেব্রুয়ারি তারা হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পান। সদর হাসপাতালের ডাক্তার ফয়সাল কোর্টে গ্রিভিয়াস সার্টিফিকেট জমা দেন।
কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন—স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, কথিত ভিকটিমরা ২৫ ফেব্রুয়ারি বিকেল পর্যন্ত তাড়াশে অবস্থান করছিলেন। ২৩ ফেব্রুয়ারি থেকে ২৫ ফেব্রুয়ারি তাদের তাড়াশে উপস্থিতির ভিডিও ফুটেজও পাওয়া গেছে এবং এলাকাবাসী এর সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন জানান, আমরা ২৫ তারিখ একসাথে পূবালী ব্যাংকের পাশে চা ও সিগারেট খেয়েছি।
আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য হলো—যে সিরাজগঞ্জ কমিউনিটি হাসপাতালে তারা ভর্তি ছিলেন বলে দাবি করা হয়েছে, সেখানে ব্যবহৃত রেজিস্ট্রেশন আইডি (১৫৫ ও ১৫৬) আসলে দুজন নারীর নামে, একজনের বাড়ি কামারখন্দে এবং অন্যজনের বাড়ি সিরাজগঞ্জ সদরে। অথচ এই আইডি দিয়ে কোর্টে প্রমাণ দেখানো হয় যে তারা হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন।
অভিযোগ ডা. ফয়সালের বিরুদ্ধে
স্থানীয়দের দাবি, সবকিছু সাজানো হয়েছিল সিরাজগঞ্জের কুখ্যাত ডাক্তার ফয়সালের সহযোগিতায়। অভিযোগ রয়েছে, মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে তিনি নিজের চেম্বারে বসেই আহতদের মাথা ইচ্ছাকৃতভাবে কেটে ‘গ্রিভিয়াস ইনজুরি সার্টিফিকেট’ তৈরি করেন, যাতে মামলা জটিল হয় এবং আসামিরা দীর্ঘদিন হয়রানির শিকার হয়।
এমনকি ডা. ফয়সালের বিরুদ্ধে এর আগেও একই ধরনের প্রতারণা ও অসাধু কার্যকলাপের অভিযোগ ছিল। পূর্বে ভুয়া মেডিকেল সার্টিফিকেট তৈরি করার অভিযোগে মামলার আসামি হয়ে তিনি সিরাজগঞ্জের বিজ্ঞ আদালতে ক্ষমা চেয়ে মুক্তি পান।
আরেক চিকিৎসকের নামও আলোচনায়
এই ঘটনায় সিরাজগঞ্জ সদর হাসপাতালের RMO ডা. শিমুল তালুকদারের নামও উঠে এসেছে। অভিযোগ রয়েছে, তিনি একাধিক অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত, যার মধ্যে রয়েছে জুয়া খেলা, নারী কেলেঙ্কারি ও অফিস ফাঁকি ইত্যাদি। স্থানীয়রা অভিযোগ করেছেন, সদর হাসপাতালকে তিনি যেনো ব্যক্তিগত ব্যবসার কারখানায় পরিণত করেছেন।
সাধারণ মানুষের ক্ষোভ
এমন ঘটনা শুধু আইনের অপব্যবহারই নয়, সমাজে অশান্তি ও বিভ্রান্তি তৈরি করছে। যেখানে একজন চিকিৎসক মানুষের প্রাণ বাঁচানোর শপথ নেন, সেখানে কিছু নীতিহীন ব্যক্তি টাকার বিনিময়ে নিরীহ মানুষকে ফাঁসাতে অমানবিক কাজে জড়িয়ে পড়ছেন।
ভুক্তভোগী পরিবারের দাবি
সাইফুল ইসলামের পরিবার বলছে—
“মজিবুর রহমানের পাল্টা মামলা সম্পূর্ণ মিথ্যা ও সাজানো। আমরা কাউকে হামলা করিনি। সবকিছু এলাকার মানুষ জানে, কিন্তু প্রভাবশালীদের ভয়ে কেউ মুখ খুলছে না। হামলা এবং মিথ্যা মামলা আমাদের পরিবার ও গ্রামের সাধারণ মানুষকে হয়রানির জন্য করা হয়েছে। আমরা ন্যায়বিচার চাই। এমন ভুয়া সার্টিফিকেট দিয়ে যারা মানুষের জীবন ধ্বংস করছে, তাদের কঠোর শাস্তি হোক।”
এই ব্যাপারে কথা বলতে ডাঃ ফয়সালকে একাধিকবার ফোন করা হলে সে ফোন রিসিভ করেনি।
এই ঘটনা প্রমাণ করে, কিছু অসাধু ডাক্তার ও দুর্বৃত্তদের যোগসাজশে কীভাবে সাধারণ মানুষ ভুক্তভোগী হচ্ছে। প্রশাসনের উচিত দ্রুত তদন্ত করে ডা. ফয়সাল ও সংশ্লিষ্ট সকলকে আইনের আওতায় আনা।
ন্যায়বিচারের জন্য এক হোক সমাজ—যাতে আর কোনো নিরীহ মানুষ এমন অমানবিক জুলুম ও প্রতারণার শিকার না হয়।










